
ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন,সময়েরআলো থেকে: আশুরা শব্দটি আরবি আশরুন, আশারা থেকে উদ্গত; যার আভিধানিক অর্থ দশ, দশম বা দশমী। শব্দটি ছিল মূলত ‘আশানুরা’ অর্থাৎ আশুরা দিবসের মর্যাদা রক্ষার বদৌলতে আলোকোজ্জ্বল জীবনের অধিকারী। ‘আশানুরা’ হতে ‘নুন’ বাদ দিয়ে শব্দটিকে ‘আশারা’ বা ‘আশুরা’-তে রূপান্তরিত করা হয়।
ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল ও ফসলাদির খাজনা বা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সঙ্গে সংযুক্তির কারণে এক দশমাংসকে বুঝাতে ‘উশর’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয় আবার পৃথিবীতে জীবনযাপন করা অবস্থায়ই পরম স্বর্গের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন অতীব পূণ্যবানকে বোঝাতে ধর্মীয় পরিভাষায় ‘আশারায়ে মুবাশ্বারা’ বলা হয়। তবে পবিত্র আশুরার ক্ষেত্রেই সমগ্র বিশ্বে এই শব্দের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়; কেননা আশুরার ঘটনা যেমন অনেক বেশি, মানবেতিহাসে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্যও তেমনি অপরিসীম।
পবিত্র আশুরায় সংঘটিত সকল ঘটনার অবতারণা না করে আমরা এখানে ‘আশুরা’ শব্দের প্রতি সুবিচারবশত ইতিহাসের অবিস্মরণীয় দশটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
প্রথমত, আল্লাহপাকের বাণী- ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খালিফাহ’ অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব। এই বাণীর আলোকে আশুরা দিবসেই মহান স্রষ্টা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বমানবের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। বেহেশতে অবস্থান করতে দেওয়া, তওবা কবুল করা এবং ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণসহ আদম (আ.)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ এই দিবসেই সংঘটিত হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, হজরত নুহ (আ.)-এর সময়কালে মহাসত্যে অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রলয়ঙ্করী মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হলে সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা থেকে শুধুমাত্র স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসী মানুষ নবি নুহের (আ.) নৌকায় আরোহণের বদৌলতে আশুরা দিবসেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহাসিক জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্তিকা স্পর্শ করেন।
তৃতীয়ত, মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই আশুরা দিবসে সংঘটিত হয়। তাঁর ঘটনাবহুল জন্ম, ‘খালিলুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বন্ধু অভিধায় ভূষিত এবং খোদাদ্রোহী নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি লাভের ঘটনা আশুরা দিবসেই ঘটেছিল।
চতুর্থত, মহান আল্লাহর নির্বাচিত পয়গম্বর মুসা কালিমুল্লাহ (আ.)-এর খোদাবিদ্বেষী বাদশাহ ফেরাউনের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে মুক্তি, নীল দরিয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা, ফেরাউন ও তার অনুসারীদের সলিল সমাধি এই আশুরা দিবসেই সম্পন্ন হয়েছিল। পরম প্রভু তাঁর প্রিয় রাসুল মুসা (আ.)-এর সঙ্গে ঐতিহাসিক তুর পর্বতে কথোপকথন করেছিলেন আশুরা দিবসেই।
পঞ্চমত, নবি ইদ্রিস (আ.)-কে মহান প্রভু পরম মমতায় পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে চতুর্থ আসমানে আশুরা দিবসেই উত্তোলন করে নেন।
ষষ্ঠত, সৌন্দর্যের আঁধার নবি ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ চল্লিশ বছর স্বীয় পিতা নবি ইয়াকুব (আ.) থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর পিতা-পুত্রের মহামিলন ঘটে এই আশুরা দিবসে।
সপ্তমত, আঠারো বছর টানা কঠিন কুষ্ঠরোগ ভোগের পর নবি হজরত আইয়ুব (আ.) নিরাময় লাভ করেন আশুরা দিবসে।
অষ্টমত, সাময়িকভাবে বাদশাহী হারানো নবি হজরত সোলায়মান (আ.) পুনরায় মহান সত্ত্বার অশেষ কৃপায় রাজত্ব ফিরে পান এই আশুরা দিবসে।
নবমত, টানা চল্লিশ দিন মৎস্যের উদরে অবস্থান করে আশুরা দিবসেই মুক্তি লাভ করেন নবি হজরত ইউনুস (আ.)।
দশমত, মহীয়সী মারইয়াম তনয় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ তাঁকে আশুরা দিবসেই দ্বিতীয় আসমানে তুলে নেন। দশজন বিখ্যাত পয়গম্বরের জীবনে সংঘটিত এসব ঘটনা ছাড়াও আশুরা দিবসে মানবেতিহাসের আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার অবতারণ হয়েছে। তবে আজকের পৃথিবীতে পবিত্র আশুরার ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও প্রভাবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো কারবালার মর্মন্তুদ বিয়োগান্ত ঘটনা; যা আহলে বাইত তথা নবি-পরিবারের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকারী এবং মহানবি (সা.)-এর কলিজার টুকরা দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে।
কারবালার ঘটনা নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। হৃদয়ের সকল আবেগ উজাড় করে দিয়ে বিশ্বখ্যাত কবিরা রচনা করেছেন অজস্র কবিতা; মানবেতিহাসের মর্মান্তিক এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিপুল সাহিত্য-ভাণ্ডার। উপমহাদেশের হোসাইন-দরদি কবি আল্লামা ইকবাল গেয়েছেন এমন শোকগাঁথা- যা আবৃত্তি করলে বা শুনলে যে কারো চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে না।
কুফাবাসীদের লক্ষ্য করে ইমাম হোসাইনের মাধ্যমে কবি বলেন, হে কুফাবাসী! আমাকে মুসাফির ভেব না, আমি নিজে থেকে এখানে আসিনি, বরং আমাকে কুফায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি অতিথি হয়ে এসে অত্যাচারিত হয়েছি, আমি আসলে কাঁদিনি বরং আমাকে কাঁদানো হয়েছে। আমার প্রভু জানেন, এ কেমন আতিথেয়তা! কেমন মেজবানি! যেখানে ৭২ জন পিপাসার্তের পানি বন্ধ! আমার ভাগ্যে তো হাউজে কাউসারের পানি রয়েছে, মূলত আমি পিপাসিত নই, আমাকে পিপাসার্ত বানানো হয়েছে। যে মস্তক নত হয়েছে খোদার দরবারে, তা আজ কর্তিত হলো কারবালার প্রান্তরে! আরে আমি তো শাহাদতের মর্যাদা পেয়ে গেলাম, আমি মৃত নই বরং আমাকে সম্মানের জীবন দেওয়া হয়েছে।
মহাকবি ইকবালের এসব বাক্য-সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আহলে বাইত তথা ইমাম হোসাইনের প্রতি তাঁর পরম ভক্তির নজরানা উপস্থাপিত হয়েছে। মূলত কুফার লোকদের বারংবার তাগিদ আর অনুরোধে আস্থা রেখে মহান ইমাম সেখানে গিয়েছিলেন; কিন্তু কুফার লোকেরা তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। কেননা তাদের ভালোবাসা আর চোখের পানিটুকুই ছিল ইমাম হোসাইনের জন্য, অন্যদিকে তাদের অর্থ-সম্পদ, শক্তিমত্তা আর যুদ্ধাস্ত্র সবই ছিলো পাপাত্মা ইয়াজিদের অনুকূলে। পিরে কামেল মরহুম নানাজানের মুখ থেকে কুফাবাসীদের বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত শুনেছিলাম; সেটি এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। ঘটনাটি এমন যে, রাস্তার ধারে বসে জনৈক ব্যক্তি কান্না করছে। একজন জিজ্ঞেস করলো, ভাই! তুমি কাঁদো কেন? লোকটি বললো, এই পাখিটি আমার, এটি মারা যাচ্ছে, তাই কাঁদছি। বললো, পাখি মারা যাচ্ছে কেন? জবাবে লোকটি বললো, ক্ষুধার যন্ত্রণায় মারা যাচ্ছে। পথিক দুঃখ পেল এবং আশেপাশে খাবারের সন্ধান করতে লাগলো। হঠাৎ দেখতে পেলো পাখির মালিকের কাছেই রয়েছে একটি থলে। বললো ভাই! তোমার এই থলের ভেতরে কী? বললো, এতে খাবার। পথিক বললো, তোমার থলের ভেতরে খাবার রেখে তুমি পাখির মৃত্যুর আশঙ্কায় কাঁদছো, এখান থেকে সামান্য খাবার দিলেই তো পাখি বাঁচে! লোকটি বললো, ভাই, তোমার এই কথা আমিও জানি; খাবার দিলেই তো আমার পয়সা খরচ হবে, কিন্তু পাখির মহব্বতে আমি যে কান্না করছি সেজন্য তো আর আমার পয়সা খরচ হচ্ছে না! কুফাবাসীর দৃষ্টান্ত এমনই!
আজো আমাদের সমাজে এমন মানুষ আছে, যারা ইতিহাসের পাষণ্ড ইয়াজিদকে তাহাজ্জুদ-গোজার আর পাক্কা নামাজি হিসেবে চিত্রায়িত করে থাকে। এদের মনোজগতে বিন্দু পরিমাণ রাসুল-প্রেম বা আহলে বাইতের প্রতি মোহাব্বত থাকলে এমনটি করতে পারতো না; এসবের মধ্য দিয়ে তাঁরা ইমাম হোসাইনের মহান স্মৃতির প্রতি শুধু যে অশ্রদ্ধাই করে যাচ্ছে তাই নয়, বরং মহান আল্লাহর ক্রোধেরও পাত্র হবে তারা। আহলে বাইতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষণ অন্য যে কোনো কিছুর চাইতে উত্তম এবং এটি বিশুদ্ধ ইমান ও আকিদার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামের মহান সত্যকে উচ্চকিত রাখতেই শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন; কোনো মতেই পাপাত্মা ইয়াজিদের বাইয়াত গ্রহণ করেননি, কিংবা তার নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। জান্নাতে যুবকদের সর্দার পৃথিবী থেকেও সর্দারের মতোই অসম সাহস, সততা আর বীরত্বের অমলিন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মানবেতিহাসের সুউচ্চ আসনে সমাসীন হয়ে আছেন। তাই আমাদের আদর্শ পথভ্রষ্ট, পাষণ্ড ও নরপিশাচ ইয়াজিদ নয়, বরং ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে আমাদের জন্য মহত্তম জীবনাদর্শ।
‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ’ প্রতিটা কারবালার পর ইসলাম আরও তেজোদীপ্ত, বেগবান ও পুনরুজ্জীবিত হয়- এটাই ইতিহাসের অমোঘ সত্য।
