
মুফতি আমিনুল ইসলাম,সময়েরআলো:আল্লাহ মানুষকে চোখের মাধ্যমে দেখার শক্তি দান করেছেন। যার চোখে আলো নেই, সে-ই বোঝে দৃষ্টিশক্তি কত বড় নেয়ামত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এই নেয়ামতের কথা বহুবার বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী! আপনি বলে দিন, তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ। তোমরা খুব সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো’ (সুরা মুলক : ২৩)। চোখ বা দৃষ্টিশক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভ হতে এমন অবস্থায় নির্গত করেছেন যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়- যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’ (সুরা নাহল : ৭৮)।
চোখের কৃতজ্ঞতা আদায় হবে চোখের উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে। চোখের উত্তম ব্যবহার হলো আল্লাহর সৃষ্টি দেখে আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করা। আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা। নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত থেকে বেঁচে থাকা। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে, কীভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আকাশের দিকে, কীভাবে তা ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে? পর্বতমালার দিকে, কীভাবে তা স্থাপন করা হয়েছে? ভূমির দিকে, কীভাবে তা বিস্তৃত করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়া : ১৭-২০) অর্থাৎ আল্লাহর কুদরত দেখে তারা শিক্ষা নিতে পারে। এভাবে আল্লাহর পরিচয় তাদের সামনে ফুটে উঠবে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে। এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (সুরা ইসরা : ১০৯)। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে অশ্রুপাত করে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারে না, যেমন দোহনকৃত দুধ ওলানে প্রবেশ করানো যায় না’ (তিরমিজি : ১৬৩৩)।
চোখের অপব্যবহার হলো আল্লাহর নিদর্শন দেখেও শিক্ষা গ্রহণ না করা। আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনা। চোখ দিয়ে হারাম জিনিস দেখা। পরনারীকে দেখা। চোখের খেয়ানত করা। চোখের জিনা ও ধর্ষণ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তো বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে, তা দিয়ে দেখে না। তাদের কান আছে, তা দিয়ে শোনে না। এরা পশুর মতো। বরং ওরা পশুর থেকেও অধিক বিভ্রান্ত। ওরা গাফেল’ (সুরা আরাফ : ১৭৯)। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা চোখের অনুত্তম ব্যবহার অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টি দেখে আল্লাহর পরিচয় পাওয়ার পরও হকের অস্বীকারকারীকে পশুর থেকেও অধম বলেছেন।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) চোখের খেয়ানতের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, ‘একদল লোকের পাশ দিয়ে যখন কোনো নারী অতিক্রম করে তখন কেউ কেউ সাথিদের কাছে এমন অভিনয় করে যে, তারা মনে করে তাদের সঙ্গী পরনারী থেকে দৃষ্টি অবনত রাখছে। কিন্তু যখনই সে বুঝতে পারে তার সাথিরা বেখেয়ালে আছে, তখন সে ওই নারীর দিকে তাকায়। এ জাতীয় অবৈধ গোপন দৃষ্টিগুলোই হলো চোখের খেয়ানত’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১৭২২৮)।
নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত সম্পর্কে নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমার অনুমতি ছাড়া কেউ যদি তোমার ঘরের ভেতর তাকায় আর তুমি কঙ্কর মেরে তার চোখ ফুটো করে দিয়ে থাকো, এতে তোমার কোনো দোষ হবে না’ (বুখারি : ৬৮৮৮)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, একে অপরের যেকোনো গোপনীয় বিষয়ে দৃষ্টিপাত থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। এ হিসেবে- ১. নারী-পুরুষ পরস্পরের সতরের দিকে তাকানো নিষেধ। পুরুষের সতর নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। নারীর সতর মাহরামদের সামনে মুখাবয়ব, হাতের কব্জি এবং পায়ের টাখনু ছাড়া বাকি দেহ। আর গায়রে মাহরামের সামনে পূর্ণ শরীর। ২. কারও ঘরের ভেতর সদর দরজা দিয়ে কিংবা জানালা ইত্যাদি দিয়ে দৃষ্টি দেওয়া নিষেধ। ৩. কারও ব্যক্তিগত কোনো তথ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত নিষেধ। ৪. কারও মোবাইলের মেসেজ, ইনবক্স ও গ্যালারি ইত্যাদি দেখা নিষেধ। ৫. কারও ব্যক্তিগত কাগজে চিঠিপত্র দেখা নিষেধ। ৬. পরীক্ষার হলে একে অপরের খাতা দেখা নিষেধ। দৈনন্দিন জীবনে এরকম আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যা হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে সামান্য চিন্তা করলেই বুঝে আসে।
কুদৃষ্টির ভয়াবহতা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে বলেছেন, ‘চোখের জিনা ও ধর্ষণ হলো হারাম দৃষ্টি’ (বুখারি : ৬৬১২)। সুতরাং চোখের জিনা ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে হলে- ১.পুরুষের জন্য গায়রে মাহরাম নারীর দিকে তাকানো নিষেধ। নারীর জন্য গায়রে মাহরাম পুরুষের দিকে তাকানো নিষেধ। ২. গঠন-আকৃতিতে আকর্ষণীয় নাবালিকা মেয়েদের দিকে তাকানো থেকেও বিরত থাকতে হবে। ৩. দাড়িহীন কমনীয় বালকের প্রতি দৃষ্টিপাত থেকেও বাঁচতে হবে।
চোখের অনুত্তম ব্যবহার থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত এবং ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন (দেহের) যা সাধারণত প্রকাশ থাকে, তা ব্যতীত তাদের রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার ওড়না দ্বারা আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ^শুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারও কাছে তাদের রূপ-সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করোÑযাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’ (সুরা নূর : ৩০-৩১)।
